হোক না ভালোবাসাটা খুব সাধারণ! ক্ষতি কী?
আজ কখন ফিরবে?
তমালকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে ওঠে চৈতালি। তমাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে ওঠে,
— কেন? যেমন ফিরি আমি। তেমনি।
— আচ্ছা।
ধীরস্বরে উত্তরটা দিয়েই হাতের টিফিনবক্সটা তমালের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয় চৈতালি। আড়চোখে একবার তাকায় তমালের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগটা এগিয়ে দেয়,
— সময় মতো টিফিনটা খেয়ে নিও।
— আচ্ছা বেশ। খেয়ে নেবো। আসছি।
বলেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় তমাল। চৈতালি তাকিয়ে থাকে ওর যাওয়ার দিকে। দরজা বন্ধ করে এসে বসে বিছানায়। বইয়ের তাক থেকে একটা বই বের করে পড়তে চেষ্টা করে। প্রায় আধ ঘন্টা মন বসানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বইটা বিছানার ওপরেই বন্ধ করে ফেলে রাখে চৈতালি। একটা বালিশ টেনে তাতে মুখ গুঁজে শুয়ে পরে।
আজ ওর জন্মদিন। নতুন বছরে মানুষ ক্যালেন্ডার এলে সবার আগে নিজের জন্মদিনটা খোঁজে। কারণ… ওই দিনটা সবার কাছেই বিশেষ হয়। বছরের বাকি দিনগুলোর থেকে একটু আলাদাভাবে কাটাতে ইচ্ছে করে।
ছয়মাস হলো চৈতালির বিয়ে হয়েছে সাধারণ মধ্যবিত্ত ছাপোষা তমালের সঙ্গে। তমাল একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করে। সঙ্গে কয়েকটা টিউশনি পড়ায়। ওদের সংসারে আড়ম্বর না থাকলেও অনেকটা সুখ আছে। সকালে একসঙ্গে গাছে জল দেওয়া আছে, বৃষ্টির বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গল্পে মশগুল হওয়া আছে, সাধারণ ডাল-ভাতে অনেকটা প্রেম মিশে আছে। কিন্তু… আজ একটিবারের জন্যও চৈতালিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়নি তমাল। আগেরদিন রাতে বিছানায় শুয়েই উসখুস করছিলো চৈতালি। এই হয়তো বারোটা বাজলেই তমাল ওকে শুভেচ্ছা জানাবে। অনেকক্ষন অপেক্ষা করেও তমালের থেকে কোনোরূপ শুভেচ্ছবার্তা না পেয়ে ঘুমিয়ে যায় চৈতালি। আজ সকাল থেকে বারবার বিভিন্নরকম করে মনে করাতে চেয়েছে জন্মদিনের কথা, কিন্তু তাও!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে চৈতালির বুক চিড়ে। হ্যাঁ ও জানে, তমাল সারাদিন অনেক ব্যস্ত থাকে। চেষ্টা করে যায় একটু সুখে থাকার। কিন্তু ব্যস্ততা কি এতটাই বেশি… যে আজকের দিনটাও ভুলে যাবে তমাল?
চৈতি। এই চৈতি। ওঠো…
হঠাৎ, একটা ডাক শুনে চমকে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে চৈতালি।বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে তমাল এসে দাঁড়িয়েছে। স্কুল থেকে কখন ফিরে জামাও পালটে নিয়েছে। এলোমেলো শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় চৈতালি। সবে তো পাঁচটা বাজে। ভ্রু কুঁচকে চৈতালি তাকায় তমালের দিকে,
— তুমি? এখন? তোমার তো পড়ানো থাকে আজকে। এক্ষুনি ফিরে এলে যে?
তমাল অল্প হেসে একটা গোলাপ গাছের চারা এগিয়ে দেয় চৈতালির দিকে,
— আজ যে আমার একটিমাত্র বৌয়ের জন্মদিন। সেদিনটা ছুটি করবোনা? শুভ জন্মদিন, চৈতি। আমার ভালো থাকার চাবিকাঠি।আমার এক টুকরো সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। গোলাপ দিলে সেই তো কদিন পর শুকিয়ে যাবে। তাই গোলাপ চারা দিলাম। যত্ন করে বড়ো করবো দুজনে।
চৈতালির চোখজোড়ায় বাষ্পরা ভীড় জমায়। অশ্রুসিক্ত চোখেই চৈতালি জড়িয়ে ধরে তমালকে,
— খুব ভালোবাসি তোমাকে। খুব!
— আচ্ছা এবার ওঠো দেখি। আরেকটা গিফট আছে।
— এই তো উপহার দিলে। আবার কী?
— উফফ! বড্ডো কথা বলো তুমি জানো তো? ওঠো দেখি শিগগির।
চৈতলির হাত ধরে ওকে বাইরে নিয়ে আসে তমাল। একটা চেয়ারের ওপর বসিয়ে দেয়।
— একদম চুপটি করে শান্ত মেয়ের মতো বসবে। একটাও কথা বলবেনা। আমি আসছি…
কয়েক মিনিটেই ফিরে আসে তমাল। বিস্মিত দৃষ্টিতে চৈতালি দেখে তমালের হাতে আলতার শিশি। সঙ্গে একটা কাঠিতে তুলো মোড়ানো। সেসব নিয়েই তমাল বসে পরে চৈতালির পায়ের কাছে। ওর হাত ধরে বলে ওঠে,
— আমার না খুব ইচ্ছে ছিল তোমার জন্য আরও দামি কোনো উপহার আনার। কথা দিচ্ছি… কোনোদিন সামর্থ্য হলে, আরও দামি উপহার আনবো তোমার জন্য। জানোই তো… তোমার বরটা বড্ডো গরী…
তমালের কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের তর্জনী তার ঠোঁটের ওপর রাখে চৈতালি,
— আমাকে চুপ করতে বলে এখন নিজেই কতো কথা বলছে দেখো! চট করে পড়িয়ে দাও দেখি আলতা। আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।
তমাল হাসে। আর কোনো কথা বলেনা। আলতায় তুলো ডুবিয়ে চৈতালির ফর্সা পা রাঙিয়ে দিতে থাকে। চৈতালি থুতনিতে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তমালের দিকে। মনে মনে ভাবে, নির্ঘাত আগের জন্মে খুব বড়ো কোনো পুণ্য করেছিল ও। সেজন্যই তো এজন্মে এমন ভালো একটা স্বামী পেয়েছে। ওর কাছে যে ভালোবাসাটাই সবথেকে দামি। এই আলতার লাল রঙে যে মিশে আছে একরাশ ভালোবাসা, সারাজীবন থেকে যাওয়ার ভরসা, ভালো রাখার বাসনা। আর এইসব কিছুর থেকে দামি উপহার কি আদেও কিছু হয়?
হোক না ভালোবাসাটা খুব সাধারণ! ক্ষতি কী?
কলমে : বৃষ্টিস্নাতা
Read more: