স্লিপার_ক্লাস প্রতিটা ট্রেনে থাকুক

স্লিপার_ক্লাস প্রতিটা ট্রেনে থাকুক নর্থ বেঙ্গলে থাকার দরুন এখন মাঝে মাঝেই সারা রাত ট্রেনে কাটাতেই হয়.. সাধারণত এসি ২ টায়ারে টিকিট ছিলো..না ভাই এখানে কেউ কারুর সাথে কথা বলে না.. এক অলিখিত নিয়ম আছে..
১. এখানে একটা ফ্যামিলি থাকবে দুই ধেরে বাচ্চা নিয়ে ওঠে (যারা চশমা পরা আর ইংলিশ মিডিয়ামের পড়ে)

ওরা কারুর সাথে কথা বলে না বাচ্চা দুটো এদিক ওদিক করলে.. পার্লার থেকে চকচকে ফেসিয়াল করে আসা মা বলেন ‘একদম অভদ্রতা নয় চুপ করে বসবে কোনো কথা নয়’…. বাবাটি প্রফেসর/ডাক্তার গোছের কেউ হবে.. উনি দু চারটে কল করবেন.. নিজের বউ বাচ্চা কেই এক্সকিউস মি বলে সর্ব নিন্ম ডেসিবেলে ফোনের কথা সারবেন.. ওরা বাড়ি থেকে খাবার আনে খুব সুন্দর এয়ার টাইট বক্সে.. চোদ্দো বার স্যানিটাইজার ইউস করে

এক সুদর্শন দাড়ি ওলা ছেলে থাকবেই.. উইন্ডো সিট পাবে স্বাভাবিক.. কানে হেড ফোন গুজবে.. সামনে ল্যাপটপ.. কি যে মরণের কাজ করবে কে জানে.. এমন ভাবে চোখ লাগিয়ে রাখবে যেনো ঢুকে যাবে ল্যাপটপে.. নাহ তিনিও করুর সাথে কথা বলবেন না.. নিজের কাজ হলে… একটা ওই সাদা মেয়নিস ওলা স্যান্ডউইচ গিলে চুপ চাপ শুয়ে পরবেন

এক কম বয়েসি মামনি.. সে ছেঁড়া ফাটা জিন্স পরে ওঠে… একা যাচ্ছে, খুব কুল ব্যাপার..হাতে একটা সবুজ লেসের প্যাকেট একটা ডার্ক ফ্যান্টাসির প্যাকেট, একটা কোল্ড ড্রিংস.. ব্যাস ডিনার কমপ্লিট.. না কারুর সাথে কথা বলে না.. আলাদাই ব্যাপার.. ব্যাগ থেকে আবার এত্ত বড় সিল্ক বের করে খায়.. দুম করে এসে বলে একটু সরে বসুন অসুবিধা হচ্ছে.. এদিকে নিজে দুই দিকে রুমাল থেকে ঢাউস ব্যাগ ছড়িয়ে বসে থাকে খুব আসতে আসতে কাউকে বলে ‘ হুম ট্রেনে, নেমে কল করবো, টেক্সট করেছি দেখে নিও

বিশাল আকৃতির এক মাঝ বয়েসি কাকু থাকে উনি যে কি করতে চান নিজেও বোঝেন না কিন্তু কোনো রকম আওয়াজ পেলেই বলেন ‘ দাদা আসতে কথা বলুন অসুবিধা হচ্ছে দাদা ৮ টা বেজে গেছে লাইট অফ করুন অসুবিধা হচ্ছে, পা সরান অসুবিধা হচ্ছে, এখান থেকে যাবেন না অসুবিধা হচ্ছে, নিশ্বাস নেবেন না আমার অসুবিধা হচ্ছে

দুজন নতুন নতুন বিয়ে হওয়া বর বউ থাকে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে মানে হানিমুন হতেও পারে.. মেয়েটার প্রথম বার এসি কোচ বুঝতে পারে না কি করবে চুপচাপ থাকে বরের কাঁধে মাথা দিয়ে দুটি তে এক সাথে এক ভিডিও দেখে এক হেড ফোন শেয়ার করে.. হাসির ভিডিও হলে হাসতে পারে না মিটি মিটি তাকায় দুজন দুজনের দিকে ফ্রাইড রাইস চিকেন আনে এট্টু মিষ্টিও থাকে শেষ পাতে.. একে অপরকে খাইয়ে দেয় না ওদের সাথে কেউ কথা বলে না

এই কোচে কোনো খাবার ওঠে না বাইরে থেকে.. সবাই মিনারেল ওয়াটার কিনেই ওঠে…তিন চার বার সুইপার আসে ফুলের গন্ধ ওলা ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করে.. মেঝে এমন ঝক ঝক করে যে চাইলেই চাটাই পেতে গড়াগড়ি দেওয়া যায়.. হাওড়া- কাটোয়া লোকাল হলে সিওর ছেলে পিলে তাস খেলতে বসে যেত যাই হোক এই কোচে কারুর ফোন জোরে বাজে না.. বাজলে সবাই তার দিকে তাকায়.. তখন সে আসতে করে সরি বলে.. কার উদ্দেশ্যে বলে জানি না

এখানে সবাই ৮ টার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়বে.. সাদা চাদরে ঢেকে যাবে পুরো বগি.. মর্গ, হসপিটাল নাকি ট্রেন ধরা যাবে না… এখানে ওয়াশ রুম ও ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিষ্কার করা হয়.. সবাই চুপচাপ টয়লেটে যায়.. টেরই পাওয়া যায় না সিট ছেড়ে উঠেছে কিনা..সে এমনই চুপচাপ চারিদিকে যে তুমি ডিপ্রেশনের যেতে বাধ্য

আমি ভাবি আমার জীবনে এতো বিষন্নতা কেনো.. কিসের দুঃখ আমার.. তারপর ভাবি দম বন্ধ হয়নি তো আমার!! ডিপ্রেশন কাটাতে কারুর দিকে তাকিয়ে হাসতে যাই.. ও বাবা সে এমন হাসে যে দাঁত বেরোয় না ঠোঁট টা এট্টু নড়ে ওঠে( ওষ্ঠে কি নিষ্ঠুরও হাস)…কি আর করবো আমিও ডিপ্রেশন নিয়ে শুতে চলে যাই…না ভাই কোনো মজা নেই এই ট্রেনে.. স্যাটিসফেকশন নেই.. ট্রেন ট্রেন ফিল নেই.. কোথায় সেই ছোটবেলার স্লিপার ক্লাস আহা.

দুই বাচ্চা নিয়ে এক কাকু কাকিমা আসবে বাচ্চা দুটো চূড়ান্ত হনুমান গোটা কোচ দৌড়াবে.. দুই বার উল্টে আছাড় খাবে.. কাকিমার কোনো হেল দোল নেই.. গুরু গুষ্টিকে ফোন করবে শাশুড়ি, ননদ, জা, বোন, বোন ঝি, পাড়ার বান্ধবি, সেই বান্ধবির বর Toto ওলা, বাড়ির কাজের বউ পল্টুর মা কেউ বাদ যাবে না সবাই কে ফোন করে বলবে ‘ হ্যালো ওও ও ও,

এই ছাড়লো ট্রেন, লুচি আলুর দম এনেছি গো মনার বাবার বাইরের খাবার খেলেই গ্যাস হয় হ্যাঁ সবুজ চুড়িদার নিয়েছি মনার বাবার হনুমান টুপি নিলাম না তো.. দার্জিলিং- এ বরফ পড়লে কি হবে গো এর মধ্যেই একটা বাচ্চা প্যা করে কেঁদে উঠবে.. দু চারটে থাবরা খাবে.. ওর মুখে লুচি ঠুসে দেওয়া হবে কাকু এর মধ্যেই গামছা, মগ, লুঙ্গি বের করে ফেলেছে.. গ্যাসের সমস্যা রাতে তিন বার বড়ো কাজে যেতে হতে পারে.

ওরা লুচি অফার করে ‘নাও না নাও আমাদের বেশী আছে’ ও বলে রাখি একটা ষ্টেশন যেতে না যেতেই সবার সাথে সবার পরিচয় হয়ে যায় ইতিহাস ভূগোল সব জানা হয়ে যায় ‘ ও দাদা আপনি হুগলীতে থাকেন বলবেন তো মশাই আমার ভায়রার মামা হুগলীর বাসিন্দা ওই খানে গঙ্গা নদী আছে না??? মাঠে ঘাস আছে না?? আকাশ নীল না??সেই কবে গেছি’

এক ছেলে উঠবে মনে হেব্বি দুঃখ উইন্ডো সিট পেলে দেখে কে খোলা জানলার ধারে পারলে সারা রাত অরিজিৎ সিং এর গান শুনবে সব কাজে হেল্প করবে ব্যাগ সাইজ করা সিট ওঠানো জানলা খোলা নামানো

খানে মাঝ বয়েসি কাকু উঠবে.. ওরে মা গো মা সে এমন তারস্বরে রাজনীতির গল্প শুরু করবে.. লাল সবুজ দলা দলি করবে যে আপনি হা করে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য… তারপর শুরু করবে কে অস্কার পেলো.. কেনো পেলো.. কে পেলোনা.. তাকে কেনো অস্কার দেওয়া হলো না মঙ্গলে এবার কে সূর্যযান পাঠাচ্ছে.. গঙ্গায় কেনো জল কম.. সব উনি জানেন.. সব বলবেন এবং সবাইকে সেটা শুনতেই হবে

এই কোচে ডিম সেদ্ধ.. ছোলা সেদ্ধ থেকে কান খুচানি বোতল পরিষ্কারের জিনিস সব পাওয়া যাবে হকার দাদা বাদাম বাদাম করে চিল্লাবে তবেই না ট্রেন একটা স্টেশনে ট্রেন থামবে কেউ না কেউ যাবে দৌড়ে জল ভরতে এখানে চোদ্দো বার টি টি আসেন আধার ভোটার গুরু গুষ্টি চেক করতে কেউ কেউ কাকুতি মিনতি করবে একটা সিট জোগাড় করে দিতে যাতে অন্তত পিছন ঠেকিয়ে যাওয়া যায় সিট যতক্ষণ পাওয়া না যায় কোনো ব্যাপার না আমার সিট তোমার সিট বসো বসো

ঠিক কেউ বসতে দিয়ে দেবে ( বেশী দাতা কর্ণ হলে মাঝ রাতে নিজের সিট কোনটা খুঁজে পাবেন না) এই কোচে সন্ধ্যে বেলা সবাই চপ মুড়ি খায় গোটা মেঝে মুড়ি, বাদাম এর ছোকলা, ঘুগনির প্লেট থাকবেই থাকবে এক গাদা হওয়াই চটি ছড়িয়ে থাকবে নতুন বিবাহিত দম্পতি ১২০ খান সেল্ফি তুলবে যা খাবার উঠবে বউ আবদার করবে সব খাবে গরম কাল হলে কথাই নেই ওপরের বাথে যে যাবে সে গেলো

জানলা দিয়ে গরম হাওয়ার হলকানি আসবে ওপরে ফ্যানের ঘড়ঘড় আওয়াজ এখানে কেউ টয়লেটে গেলে সবাই জানতে পেরে যায়’ও দাদা আমার ব্যাগটা দেখবেন’ বলেই পরম বিশ্বাসে ব্যাগ অন্যর হেফাজতে রেখে দিব্যি কাজ সেরে আসে ৩০ মিনিট পর থেকে টয়লেট থেকে যা মধুর সুবাস আসবে তা সব ফিনাইলকে হার মানাবে

নাকে যা চাপা দাও কিচ্ছু কাজে আসবে না… চুপচাপ ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়তে হবে.এখানে বালিশ চাদর কিছু দেবে না.শুতে গেলেও দাবি আসবে ‘বাচ্চা আছে আপনার লোয়ারটা দিন না.আমাদের মিডিল না হয় দিয়ে দেবো.. জানলার ধারটা একটু দেবে গো এই তুমি তো কম বয়েসি ছোকরা যাও না ওপরে উঠে যাও’

এসি কোচে সবাই যখন নিশ্চিন্তে ঘুমায় স্লিপারে চলে এডজাস্টমেন্ট কেউ বাথ ভাগ ভাগি করে কেউ টয়লেটের গন্ধে নাকে দুটো রুমাল বাঁধে কেউ বসে বসেই চলে যায় গোটা রাত ওরা হাসা হাসি করে গল্প করে রাত ১০ টা পার হয় একে ওকে দিয়ে ভাগ করে খাবার খায় দুই কাকিমা শাশুড়ির নামে নিন্দে করে ঘুমাতে যায় মাঝ রাতে বাচ্চা কেঁদে ওঠে সেই কাকু জোরে জোরে নাক ডাকে.. আসতে আসতে চারিদিক শব্দহীন হয় রাত বারে ট্রেন বিদ্যুৎ এর গতিতে ছুটে চলে তার স্লিপার ক্লাসকে নিয়ে অজানা স্টেশনে ট্রেন থামলেই স্টেশনে থাকা তীব্র আলো চোখে এসে ঘুম ভাঙাবেই

আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে ভোর হবে ট্রেন এন জি পি পৌঁছাবে সবাই হাসতে হাসতে নামে কেউ কেউ হয়তো প্রথম বার পাহাড় দেখবে কেউ সাহায্য করবে বড়ো ট্রলি নামাতে হাত মিলিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হবে যেখানে এসি কোচে কেউ কাউকে চেনে না নিজের লাগেজ নিজেরাই নিয়ে নেমে যাবে যে যার মতো প্রতিটা ট্রেনে থাকুক স্লিপার ক্লাস থাকুক চেঁচামেচি.স্লিপার_ক্লাস প্রতিটা ট্রেনে থাকুক না হলে মানুষ মানুষের দিকে তাকাতে ভুলে যাবে

#শ্রীতমা

স্লিপার_ক্লাস প্রতিটা ট্রেনে থাকুক

Read more:

আমি মানুষ টা একটু অন্য রকম ভাবুক প্রকৃতির

Follow us on facebook