অসহায় বৃদ্ধ,বৃদ্ধা পড়ে আছেন ঐ বাড়িতে জীবন যখন যেমন, অভিযোগ নেই কভু কারো প্রতি,সন্তান’রা রয়েছে বহু দুরে।
বাড়িটি’র আনাচে কানাচে পড়ে আছে, কত শত ক্ষণের ছবি, কত স্মৃতি, কত জীবনের ব্যস্ততা। আজ কেউ নেই, কোন নেই ব্যস্ততা, নেই কারও আব্দার শুধু দিন কাটে দুজনে দুজনের মুখপানে চেয়ে চেয়ে।”

আমাদের ছেলে মেয়েরা চাকরি বা বৈবাহিক সুত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা বিদেশে বসবাস করে আর আমাদের বাড়ি/ফ্ল্যাট এক একটি বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত হয়েছে। আমাদের তখন একমাত্র অবলম্বন হলো স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গ পাওয়া। খোঁজ পড়ে সেই পুরনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের। ফেসবুক আবার পুরানো বন্ধুদের কত কাছাকাছি টেনে আনে এবং তখন তাদের একটি মাত্র অক্সিজেন হলো বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা। তারই একটা নিদর্শন আমাদের এবারের ছোট একটা ভ্রমণ। আমার স্ত্রী তার ইউনিভার্সিটি যুগের আরো চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হওয়াতে সেই সুত্র ধরে আমরা পাঁচজন স্বামীও বন্ধু হয়ে গেলাম।

এখন দরকার আবার সেই কম বয়সের মতো হইহুল্লোর করার জায়গা। হঠাৎই একটি সুন্দর জায়গার হদিশ পেলাম ফেসবুকের ভ্রমণ গ্রুপে। জায়গার নাম যেমন সুন্দর তেমনই সুন্দর এইখানে রাত্রিবাসের জায়গাটির নাম: “আসান নগর” (নদীয়া জেলা) স্থিত “প্রকৃত হোমস্টে”
কলকাতা থেকে মাত্র ১৩০ কিমি দূরে ঝোর নদীর তীরে গ্রাম্য পরিবেশে তৈরি হয়েছে এই হোমস্টে। হোমস্টের ডিটেইলস দেওয়ার আগে আপনাদের জানাই এই জায়গাটির সম্বন্ধে।

গ্রামের একদিক দিয়ে বয়ে চলেছে নীল গভীর জলরাশিতে ভরপুর ঝোর নদী। আর ঠিক তার পাশেই গড়ে উঠেছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত একটি হোমস্টে। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে যেমনভাবে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়, আমাদেরও সেইভাবে আপ্যায়নেও করা হলো।
কাঁসার থালায় পরিপাটি করে বানানো সুন্দর সুন্দর খাবার পরিবেশন করা হলো। অরগ্যানিক পদ্ধতিতে ক্ষেতের সবজি, চাল, ডাল, হলুদ, মশালা সবই তৈরি হয় এই হোমস্টের নিজস্ব জায়গায়।

বিকেলে গেলাম বনবিবির তলা দেখতে।প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত এই বটতলা। বিস্তৃত এই বটগাছের প্রকৃত গোড়া খুঁজে পাবেন না। কেননা গাছের শাখা-প্রশাখা শিকড় থেকে বিরাট। বনজীবীদের বিশ্বাস, বাদাবনের রক্ষক বনবিবির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে এই বিশাল বটটার। এটার পাতায় পাতায় মিশে আছেন বনবিবি। তিনি বনজীবীদের কাছে স্বহিমায় পূজিত দেবী।

সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে পাখির ঘরে ফেরার দৃশ্য যে যার মোবাইলের ক্যামেরা বন্দী করে রাখলাম যাতে অন্তত বেশ কিছুদিন এই স্মৃতি থেকে যায়। একদিকে পাখির কলরব আর একদিকে সূর্যাস্তের লাল-কমলা থালাকৃতি রূপ আপনার মন হৃদয় রঙিন করে দেবে।
দ্বিতিয় দিন শুরু হলো গাছ থেকে পাড়া টাটকা খেজুর রস পান করে। আহা কি মিষ্টি আর সুস্বাদু। ব্রেকফাস্ট সেরে চলে গেলাম মায়াপুর ইস্কন মন্দির। হোমস্টে থেকে গাড়িতে এক ঘন্টার রাস্তা। মায়াপুর মন্দির সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই কারণ ইস্কনের এই মন্দির প্রায় সকল পশ্চিম বঙ্গবাসীর ঘোরা।

সন্ধ্যে বেলায় হোমস্টের বারান্দায় বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে মশলা মুড়ি ও বেগুনি সহযোগে গ্রাম্য মানুষগুলির দিন যাপনের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে। সাথে এই হোমস্টের এক কর্মচারী হরি কাকার সুমধুর বাঁশীর সুর পুরো সন্ধ্যাটা এক আলাদা মাত্রায় পৌঁছে দিল। এই হোমস্টেতে কাজ করেন গ্রামেরই কিছু মহিলা, যাঁরা কাজের সাথে সাথে কিছু হাতের কাজও করে থাকেন। তেমনই একটি নকশি কাঁথা চাইলে আপনি সরাসরি তাঁদের কাছ থেকে কিনে নিতে পারেন। তারা কোনো সাহায্য চায় না, তারা চায় তাঁদের হস্ত শিল্পের উপযুক্ত মর্যাদা। রাতের খাবার খেয়ে চাঁদের আলো দেখতে দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম কতক্ষণ গেজিয়ে কাটালাম।

আজ আমাদের শেষ ও তৃতীয় দিন আমাদের নিজেদের বৃদ্ধাশ্রমে ফেরার পালা। দুটো দিন চুটিয়ে আনন্দ হোলো আর প্রকৃতি সৌন্দর্য পুরো উপভোগ করা হোলো। আবার সেই মধ্যবিত্তের বস্তি বাড়িতে ফেরার পালা।

এখানে কিভাবে পৌঁছবেন:

১. কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর বা গেদে লোকাল ধরে চলে আসতে হবে মাজদিয়া স্টেশনে। এইখান থেকে ১২ কিমি পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন আসান নগর।
২. কলকাতা স্টেশন থেকে হাজার দুয়ারী এক্সপ্রেস ধরে কৃষ্ণনগর সিটি জং নেমে গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ১৬ কিমি পথ।
৩. কলকাতা থেকে গাড়িতে কল্যাণী এক্সপ্রেস হয়ে বা NH-৩৪ ধরে ১৩০ কিমি পথ মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যেতে পারেন এই আসান নগরে।