টুকাই ও সেই টিয়া পাখি

টুকাই ও সেই টিয়া পাখি

টুকাই। স্পেশ্যাল চাইল্ড। আমার ছোট জেঠুর দত্তক সন্তান। এখন সে সদ্য তরুণ। আর দশজনের থেকে একদম আলাদা। স্বাভাবিক হাঁটাচলা বা কথা বলা, কোনওটাই পারে না। খাইয়ে দিলে খায়, না দিলে খায় না। আপন মনে সারাদিন বসে থাকে আর নানারকম সুরে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। ছেলেটা স্নান করতে বড্ড ভালোবাসে। স্নানে তার এমনই নেশা যে যখনই বাথরুমে যাবে স্নান ওকে করাতেই হবে। না হলে কার সাধ্য ওকে বাথরুম থেকে বের করে! সে শীত হোক বা গ্রীষ্ম। ছেলেটার চোখেমুখে একটা অদ্ভুত মায়া আছে। বাড়ির সকলে ওকে খুব ভালবাসে।

কিন্তু কিছুদিন ধরেই আমাদের বাড়িতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল। একটা টিয়াপাখি রোজ আসতে থাকে টুকাইয়ের কাছে। কারও পোষা নিশ্চয়ই নয়। পোষা হলে সে খাঁচা বন্দী থাকত। টুকাইয়ের কাছে আসত না! পাখিটা কোথা থেকে আসে, থাকে কোথায়, কোথায় বা ফিরে যায় কিছুই জানতে পারিনি। ছোট জেঠুর বাড়িতে আসাটা ওর একটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সকাল হতে না হতেই চলে আসত। দুপুরে একবার উড়ে যেত। আবার ফিরে এসে থাকত সন্ধ্যে পর্যন্ত। কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

পাখিটার অদ্ভুত কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। খাওয়ার ব্যাপারে ওনার কোনও আগ্রহ নেই। কেউ কিছু খেতে দিলেও খাবে না। শুধু সারাক্ষণ টুকাইয়ের সঙ্গেই থাকবে। তবে পাখিটা নারীজাতিকে মোটেও সহ্য করতে পারত না। ও যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমার জেঠিমা বা আমি কেউ টুকাইকে ছুঁতে পারতাম না। ছুঁলেই ও রেগে গিয়ে কামড়ে দিতে আসত। জেঠুকে অবশ্য কিছু বলত না। পাখিটার এই অদ্ভুত মনোভাবের কী কারণ বোঝা মুশকিল। কখনও সে টুকাইয়ের ঘাড়ে বসবে, কখনও মাথায়, কখনও পায়ের ওপর। ওর খোঁচা খোঁচা নখে টুকাইয়ের অস্বস্তি হয়। সে বেচারা মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারে না বলে হাতে করেই সরিয়ে দেয়।

কিন্তু এমন নাছোড়বান্দা পাখি যে টুকাই হাজার হাত পা ছুঁড়লেও কিছুতেই ওকে ছেড়ে যাবে না। টুকাইকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হলে তারও টুকাইয়ের সঙ্গে বাথরুমে যাওয়া চাই। আবার টুকাইয়ের বাথরুম থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে সেও বেরিয়ে আসবে। সারাক্ষণ ক্যাঁকোর ক্যাঁকোর করে কী যে কথা বলে টুকাইয়ের সঙ্গে কে জানে। টুকাইয়ের ভাষা যেমন পাখিটা বোঝে তেমন পাখির ভাষাও বোধ হয় একমাত্র টুকাই বোঝে। অনর্গল টুকাই এর সঙ্গে কত কী যে কথা বলে চলে। আসলে পশুপাখিরা এই ব্যাপারে মানুষের থেকে বেশি সংবেদনশীল হয়। তারা বুঝতে পারে, কে তাদের কতটা ভালবাসে।

টুকাই যখন ঘুমোত, তখন সেও মশারির ভেতরে টুকাইয়ের মাথার কাছে চুপ করে বসে থাকত। যখন ওর শরীর খারাপ হত, তখন এক মুহূর্তের জন্যও পাখিটা টুকাইকে চোখের আড়াল হতে দিত না। সেই সময় কেউ যদি টুকাইয়ের গায়ে হাত দিতে যায় তো সেই টিয়া চিৎকার জুড়ে দেবে। এমনকী কামড়েও তার দ্বিধা হত না। ভারী অদ্ভুত একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ওদের মধ্যে। টুকাই কথা বলতে না পারলে কী হবে! পাখিটা অনর্গল কথা বলে টুকাইয়ের ভাষার অভাব পূরণ করে দিত। মাঝে মাঝে ভাবি, এত মানুষ থাকতে ওই পাখিটা শুধু টুকাইয়ের কাছেই কেন আসত?

অনেকের কাছেই হয়ত ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। মনে হবে, সিনেমা বা সাহিত্যের কোনও কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু এরকম ছবিটাই ছোট জেঠুর বাড়িতে বরাবর দেখে এসেছি। একদিন বা দুদিন নয়, টানা ছ-বছর ধরে রোজ আসত সেই টিয়া।

পাড়ার অনেকেই বিষয়টা জানে। অনেকে শুধু মাত্র সেই পাখিটাকে দেখতেই জেঠুর বাড়িতে আসত। তারপর একদিন হঠাৎ সেই পাখিটাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল পাশের বাড়ির কার্নিসের ছাদে। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল জানি না। টুকাইয়ের মধ্যে কী ভাবান্তর হয়েছিল সেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে নেই।

কিন্তু পাখিটা কে ছিল? টুকাইয়ের সঙ্গে কী তাহলে পাখিটার পূর্বজন্মের কোনও যোগসূত্র ছিল? উত্তর নেই। আসলে এই পৃথিবীতে আজও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। টুকাইকেও যখন মাঝে মাঝেই বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতে দেখি, তখন মনে হয় সেই পাখিটাই তো ওর একমাত্র বন্ধু ছিল। যদি একবার সে ফিরে আসত!

অন্তরা চৌধুরি

Read More :

কতদিন কতরাত কেবল পরিচিত ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে

কতদিন, কতরাত কেবল পরিচিত ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। অহেতুক নিজেকে আটকে রাখার মিথ্যে প্রয়াস চলে খালি। নিঃঝুম দুপুরগুলোতে বা বেলাশেষের বিকেলগুলো তে ইচ্ছে হতো ইট-কাঠ-সিমেন্টের জঙ্গল ভেদ করে অচিন কোনো গ্রহে পারি দিতে। কিন্তু, না।

গানের জাদুতে মাতিয়ে রেখেছে অদিতি চক্রবর্তী